72nD pOsT : প্রদীপ চক্রবর্তী


অস্তিত্বঃ ২
আমার আলোচ্য কবিতার নাম ‘অস্তিত্বঃ ২’। সমরজি সিংহের ‘গোধূলিরচিত’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত এটি। পৌণমী প্রকাশন , আগরতলা , ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত। ২৬ ফেব্রুয়ারি , ২০০০ , আগরতলা বইমেলার এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ পায়। এটিই এখনও সমরজি সিংহের শেষতম কবিতার বই। ‘লেটেস্ট’। এর আগে প্রকাশিত এই কবির অন্য তিনটি কাব্যগ্রন্থ , মাধবীলতা , উসর্গপৃষ্ঠা , কৃষ্ণতরল। ৫৬ পৃষ্ঠার সাম্প্রতিক কবিতার বইয়ের শেষ কবিতাটি ‘অস্তিত্বঃ ২’। এবং কেন অন্য কবিতাগুলিকে ছেড়ে দিয়ে এই শেষ কবিতাটি নিয়ে লিখতে বসলাম , এবং কেনই বা আমার অনুভব এখানে এসে গভীর আত্মানুসন্ধানে ব্যস্ত হল , সেটি ভেবে দেখার।
প্রথমেই ত্রিপুরা থেকে (আগরতলা) , প্রকাশিত একটি বিশেষ সাহিত্য পত্রিকায় সমরজি সিংহের একটি সাক্ষাকারের কথা মনে পড়ে যায়। পত্রিকাটির নাম ‘জিপসীদের তাবু’।বিশিষ্ট কবি রণজি দাশের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘জিপসীদের তাবু’। এই নামটিই এখানে , এই পত্রিকায় গৃহিত হয়েছে। সাক্ষাকারটি বিস্ফোরক,খোলামেলা , উপভোগ্য , চেতনার গোড়ায় মনসার ধুঁয়ো দেওয়া চিন্তামণি। ভালোমানুষের পুত্র , অনর্গল গড়িমাচূড়ায় বসে , যেভাবে পতিত মানুষের দিকে পিঠ দিয়ে বাতিকগ্রস্তের মত বসে থাকে , সে ভেসে আসা গান শোনে না , টালবাহানা করে , সে সজ্জন ব্যক্তির পোষাকে শ্বশ্রুমাতাঠাকুরানীর কন্যাটিকে যাবতীয় দায়িত্ব দিয়ে , বঙ্গসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে আর নিজের শিশ্ন বেয়ে নেমে আসা-যাবতীয় তরলের দিকে তাকাতে অন্ধকারেও লজ্জা পায় ! তার খিদে সত্য , ধর্ম এবং জিরাফও সত্য অথচ সে লাজুক লবঙ্গলতিকাটি। এই শ্রেনীর মধ্যমপদবাচ্য ব্যক্তিদের কে প্রায় ফুকারে , বিদ্রুপে হাসির পাত্র করেও সমরজি তাদের কে একদম উড়িয়েও দেননা। এক মিশ্র মমত্ববোধ এবং আমির অবস্থানও ‘ আইডেনটিটির ’ সম্পর্কে নিজস্ব পর্যবেক্ষন আছে বলেই হয়তো। তাই যখন সেই পত্রিকাই প্রশ্নের অছিলায় কিছু ‘ বালখিল্য ’ প্রশ্ন করা হয় , যদিও সব নয় , (ব্যতিক্রমী- বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নও আছে ,) তখন যাবতীয় প্রশ্নকে এবং সরসতায় প্রশ্নকর্তাকেও অতিক্রম করে যায় তার উত্তরের যাবতীয় ঐশ্বর্য। যেমন ‘ শব্দ ’ প্রয়োগ। প্রশ্নকর্তা বলেন , সমরজি শব্দ নির্বাচনে প্রাচীন পন্থী বা পুরনো ঘরানার। আর এখান থেকেই আমার যা মনে হয় , তা হলে ‘ শব্দ ’ সম্পর্কে ধারণা। তার প্রয়োগ কৌশল। শব্দের কোন অর্থ নেই। এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। শব্দ প্রায় , প্রায় কেন , সর্বত্রই ধ্বনি এবং চিত্রের প্রতিক , ‘ কাপ ’- বলতে চিরকালই একটি নির্দিষ্ট ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। টেবিল , কলম , বই , আরামকেদারা , ঝর্ণা , সিংহাসন , কম্পিউটার , নাগকেশর ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রায় অভ্যস্থ হয়ে যাওয়া কতকগুলি ছবি। যেমন ঘন্টা , মন্দির , উপাসনা ভবন , গুরুপল্লী , রবীন্দ্রনাথ। কতকগুলো ব্যক্তি বা বস্তুর সঙ্গে পরিচয়ের জন্য ব্যবহৃত শব্দ। এখন প্রশ্ন হলো , এই শব্দ সেই দৃশ্যের সঙ্গেই যুক্ত , ব্যক্তি বা বস্তুর সঙ্গে যুক্ত , যাদেরকে দীর্ঘদিন ঐ নামেই ডাকতে আমরা অভ্যস্থ। আর এই অভ্যাস ধীরে ধীরে রক্তে-মজ্জায় মিশে গিয়ে সংস্কারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই অভ্যাস , বস্তু ও ব্যক্তির ব্যবহার , আচরন ইত্যাদি থেকে যে শব্দের মাধ্যমে তাদেরকে চিহ্নিত করতে আমরা অভ্যস্থ , এখন যদি সেই শব্দের দ্বারাই অন্য কোন বস্তুর ক্রীয়াকর্মের বৈশিষ্ঠকে আমরা তুলে ধরি , যদি কিছু মানুষের অভ্যস্থ সংস্কারকে , প্রচলিত-চালু-বহুব্যবহৃত-ক্লিশে হয়ে যাওয়া ধারণাকে ভেঙ্গে , সম্পূর্ণ নতুন ভাবে , নতুন ভাবনা বা – নতুন চেতনার স্পার্কে , তাকে ব্যবহার করি , তাহলে অভ্যস্থ ছবির ব্রেক হয়। ভেঙ্গে যায় যাবতীয় ঐতিহ্যের প্রতি ভ্রান্ত ধারণার পুনরাবৃত্তি। সমরজি পুরানো শব্দকেই অনেক জায়গায় নতুন ভাবে প্রয়োগ করেছেন। আর যে সব জায়গায় তার অনুভব , বোধ , অভিজ্ঞতা , প্যাশন এবং ইন্টেলেক্ট মিশে , শব্দের সুনির্বাচিত প্রয়োগে উত্তীর্ণ হয়েছে , সে সব জায়গায় তার নিজস্ব – গূঢ় ক্ষমতাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। হ্যাঁ এটা ঠিক , ‘ নতুন শব্দ তৈরী ’ সমরজি কম করেছেন , তবে অনেক শব্দ ব্যবহারে হয়ে উঠেছে ব্যঞ্জনাধর্মী। আর অভ্যস্থ ধারণাকেও ভেঙেছেন অন্যভাবে প্রয়োগ কৌশলে।
ছেদ ও যতিচিহ্নের প্রয়োগে ‘ তাঁর ’- কবিতায় কেউ উপলকুমার বসুর ছায়া খুঁজে পান। এখানে আমার কিছুটা আপত্তি। কেউই স্বয়ম্ভু নন। প্রভাব থাকেই। তবে এর মধ্যে থেকেই একজন ‘ স ’ কবি মৌলিক হয়ে ওঠেন। ‘ স ’ শব্দটি প্রয়োগ করলাম এই জন্যই , যুগটা রিমিক্স , রিমেকের। শব্দটার আপেক্ষিকতা থাকতে পারে , ক্ষণবাদ বা তাক্ষণিকতার প্রবল যুক্তিকে অস্বীকার না করেই বলা যায় , সমরজি ভালোবাসেন ‘ উপল কুমারের ’ কবিতা। যেমন রণজিদাশ , এক্রাম আলী , শক্তির। যেমন পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের। তাতে হয়েছে কি! নিজেকে ‘ সুরভরা দূর নীলিমা ’ থেকে আবিষ্কার , অতিক্রমণ , অবিমিশ্র জটিল অনুভব ও ভ্রাম্যমাণের ধূসর পালক থেকে ধুলো ঝেড়ে , নিজের প্রতিমুহুর্তের জাগ্রত বিবেকের টুপিতে ক্রীসমাসের সনেটগুচ্ছ ঝালিয়ে নেন তিনি অনায়াসে। পরজন্ম প্রধান কৃষ্ণতরলে ডোবেন , অসিদ্ধ – সিদ্ধির পুরুষ প্রধান , তদ্ভবসভ্যতার শ্মশানে। ডুবে অন্ধ হতে চান , যদিও অন্ধত্ব প্রধান , কিশোর কর্মের প্রতি , তাঁর ঘোর আপত্তি।
সমরজি সিংহ ত্রিপুরার মানুষ। পাহাড় , অরণ্য  , নদী , রাজ পরিবার , ঐতিহ্য , পুরাণশহর ত্রিপুরা। মেইতেই আর বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায় , ককবোড়ো ভাষা আর সাম্প্রতিক চরম্পন্থী কার্যকলাপ নিয়ে অগ্নিগর্ভ ত্রিপুরা। রক্তপাত , এত রক্তক্ষয় , মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরা রাজপরিবার নিয়ে লেখা ‘ বিসর্জন ’ নাটকের কথা। ঘন ঘন বদলে যাওয়া পট , গুপ্তহত্যা , রহস্য , ষড়যন্ত্র , নির্বাসন। আর এর মধ্যেই এখনও গোমতী বয়ে যায়। আর তার দুই তীরের ঘন বসতীপূর্ণ জনসমষ্টি তাদের দৈনন্দিন ছোট ছোট সুখ , দুঃখ , হাসি , কান্না নিয়ে আজও বেঁচে আছেন। শারীরিক ভাবে কখনো আমি ত্রিপুরায় যাই নি। কিন্তু ওখানাকার অনেক মানুষ জন , যারা কর্মসুত্রে দুর্গাপুরে এসেছেন , অনেক কবি-সাহিত্যিক আমার অন্তরঙ্গ , আমার আপন। উত্তরে কাঞ্চনপুর , কৈলা শহর। যেখানে প্রবাহিত মনুনদী। আর সেখানেই কবি সমরজি সিংহের জন্ম। অনেক টানা-পোড়েন , ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে সমরজি আজ ত্রিপুরার আগরতলায় তথ্য ও পর্যটন বিভাগের পদস্থ কর্মী। আর এটা গেল তার সাধারণ , বাহ্যিক পরিচয়। এই পরিচয় দিয়েই কি কোন কবির সবটুকু গোপন প্রকৃতি বোঝা যায়? 
তার ‘ অস্তিত্ব  ২’ পড়তে পড়তে দেখি এক অন্য সমরজি কে। “আমাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা। ডায়েরি , গ্রন্থ , বিছানা বা ওয়্যারড্রোব , / সর্বত্র , তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলাম। রান্নাঘর , বাথরুম , বইয়ের র‌্যাক , / সোফার নীচে , টিভির পেছনে , জানলায় , বাক্সপ্যাটরার ফাঁকে , কোথাও / আমি নেই। তন্ন তন্ন করে খুঁজে যাচ্ছি। সারাদিন গেল। এখন গোধূলিপ্রান্ত / থেকে অদ্ভুত নীলচে লালরঙ ঢুকে পড়ছে ঘরের ভেতর। স্কুলমাঠ পেরিয়ে / ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠছে আকাশ। যেন কড়াইয়ের পিঠ পুড়ছে উনুনে। / দু’ একটা নক্ষত্র ফুটছে সেখানে। ঐ স্কুলমাঠে , আকাশে , কোথাও আমি নেই। / চারিদিকে বেজে উঠছে শঙ্খ , উলুধ্বনি , গীর্জার ঘন্টা , আজান , এসবের / ভেতর মৃতদের দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে। ঐ ধ্বনি , দীর্ঘশ্বাসের ভেতর / আমি নেই। দুপুরে , স্যারের বাড়ি , বলে , যে তরুণী গেল প্রেমিকের / কাছে , তাদের প্রেমেও আমি নেই। সিনেমা হলে , রেস্তঁরায় , পার্কে , / শালবাগানের নির্জনতায় , কামান চৌমুহনীর ভীড়ে যে চুম্বন ও স্পর্শ / তাদের প্রাণিত করে , সেই স্পর্শেও আমি নেই। ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের / ভেতর ডুবে গেলাম তারপর। কাগজের টুকরোর মতো সংসার , / দায়িত্ব ও মমতা কুচিকুচি করে উড়িয়ে দিলাম হাওয়ায়। / ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে তা। আমি সেখানেও নেই। / ক্লান্ত হয়ে , হাঁটু গেড়ে , মাথানুইয়ে বসে পড়লাম , তখনই , দেখি , / দরোজায় দাঁড়িয়ে সে। আমার পরজন্ম । তাকেও জিগ্যেস / করলাম , ‘ আমাকে কোথায় পাব?’ কোনও উত্তর দিল না , শুধু / হেসে উঠল , যেন সে নিশি , আমাকে ডাকতে এসেছে।”
ওপরে  সমস্ত কবিতাটা দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না। এই কবিতাটি নিয়ে আলোচনার আগে ২৫ বছরেরও বেশি সময় জুড়ে বাংলা কবিতা লিখে যাচ্ছেন সমরজি সিংহ। তার একটি সাক্ষাকারে , নিজের কবিতা ও বেচে থাকা নিয়ে , নিজস্ব স্বাধীন মতামত যা স্পষ্ট ভাবে তিনি বলেছিলেন বিভিন্ন বাঁক , জঙ্গলের নাভি , অরণ্যসঙ্কুল পাহাড় , অনাব্য নদী খাত ও কুয়াশাচ্ছন্ন উপত্যকায় ঘেরা ‘ জিপসিদের তাঁবু ’ নামে ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত একটি সাহিত্য পত্রিকায় , সেই চিন্তাভাবনাগুলোকে প্রথমেই পাঠকদের সামনে সাজিয়ে দিচ্ছি। ১) ভার্জিনিটি , কুমারীত্ব কথাটির মধ্যে কেমন পুজো পুজো ভাব , ধুপধুনোর গন্ধ। খুবই অশ্লীল ব্যাপার। আর আমার কবিতা প্রসঙ্গে ‘ বিষয় কৌমার্য ’ শব্দটি এলে , বিশেষ করে কৌমার্য কথাটি শুনলেই , তা হরণের চকিত বাসনা মনে জাগে। ২) ত্রিপুরায় টপিক্যাল কবিতার কদর বেশি। জুমক্ষেত। উগ্রপন্থী সমস্যা , জোতদার , শোষণ , চক্রান্ত কত টপিকস আছে ছড়িয়ে। আমি সে ভাবে কখনো ভাবিনা। ভাবিওনি। কবিতা , আমার কাছে , ইংরেজিতে যাকে বলে , ফীলিংস অব কনসাস এন্ড আনকনসাস , তাই। তা , আমারই। তার চেয়েও বড়কথা , আমি তো , নানা দিক থেকে , নিজেকেই দেখতে চাইছি। চারপাশসহ , চারপাশ ছাড়া। একবার বাথরুমে , একবার ড্রেসিংটেবিলের বড় আয়ানায় , ছোট আয়নায় বা ভাঙ্গা আয়না দিয়ে। অথবা কারো চোখে। নানা অ্যাঙ্গেলেনিজের নগ্নরুপ দেখার আনন্দে মেতে আছি। এ থেকে , মনে হতেই পারে ,  আমি নার্সিংসাসতা , আমি নাচার। আমি না থাকলে , আমার পৃথিবীও যে থাকে না। আর এটাও তো সত্যি , আমার পরিধির বাইরে আমার কবিতা যাবে কী করে? সম্ভবও নয়। ৩) আমার কবিতায় এত কমা , সেমিকোলন। কোন শব্দকে কতটা গুরুত্ব্ব  দিতে হবে তার আয়োজন। কারণ , মসৃণতা বা পেলবতা , আমার ধাতে সয়না। আফটার অল , লাইফ ইজ নট সো স্মুথ। অন্তত , আমার জীবন তো নয়ই। ৪) ঈর্ষা না থাকলে , মানুষ দেবতা বা শয়তান হয়ে যাবে। তা , ঈর্ষার সঙ্গে ‘ নারীত্বের ’ সসম্মান অবস্থিতির বিরোধ কোথায়? আমি তো কোন লাফড়া দেখছিনা। প্রেমেরই এক রুপ বা প্রকাশভঙ্গী ঐ ঈর্ষা। ৫) নারী , জাতি  হিসেবে , আমার খুব শ্রদ্ধার। মা জগজ্জননী তারা! আমার মা নারীশ্রদ্ধা করি? ভালবাসি। আবার , হ্যাঁ। ঘৃণাও করি। এই জটিলতাই আলো-আধাঁর। স্ত্রী লিঙ্গ হিসেবে , ভাবতে গেলে , শুধু বিছানার কথা মনে পড়ে। এটাও , আমার শরীরে , ধমনীতে , যে ফিউডাল রক্ত বইছে তার জন্যে। আমার পিতার স্বীকৃত-অস্বীকৃত পত্নী উপপত্নীর সংখ্যা অন্যূন ৬। ৬) আমারই বংশের কোন পূর্বপুরুষ , আমাদের ঘরে , পরী ধরে পুষতেন। এই সঙ্গে , আর একটা তথ্যও দিচ্ছি , আমার পূর্বপুরুষ , হিউয়েন সাঙ্ আমাদের বাড়িতে এসে , ফিরে যাবার পর , ব্রহ্মদেশের রাজকুমারীকে হরণ করে এনে , পেটিকারায় , খুন করিয়েছিলেন। আমি এখনো ঐ পরীর স্বপ্ন দেখি। ৭) আনন্দ , সূর্যোদয় , রাঙ্গামাছ , নীলপাখি , জয় , সফলতা , পূর্ণতা – ইত্যাদি নিয়ে লিখব বলছেন? একটা কথা আপনাদেরই জ্ঞাতার্থে জানাই ঐ যে ‘ জীবনের পক্ষে ’ কথাটি যারা বলেন , তারা মিথ্যে বলেন। ভড়ংবাজ বললেও , তাদের যথার্থ চিহ্নিত করা যায় না। প্রতি মুহূর্তে প্রতারণা করে যান এরা , নিজের সঙ্গে , মানুষের সঙ্গে। ৮) বাঁকের মুখোমুখি না হলে , মুখোমুখি হবার সাহস না থাকলে , গলিঘুঁজির ভেতরে না ঢুকলে ‘ পদ্য পর্যন্ত ’ আপনি অগ্রসর হতে পারবেন , কবিতা নয়। যা নাস্তি , তাও অস্তিরই নিশিরূপ। ৯) আগরতলায় বসে , জুমের কান্না , টংঘর , উপজাতি দরদ ইত্যাদি নিয়ে ছেনালিপনা করতে পারিনা। ১০) বরং একদিন স্যুইসাইড করি। করার আগে , একটা ক্ষুর সংগ্রহ করে , গলায় চালাবার চেষ্টাকরি , ডানহাতের শিরা কাটবার আর একবার। শেষ পর্যন্ত ঘুমের বড়ি খাই। সে ৮১ সালের ২২ জানুয়ারির রাত্রি। ২৬শে জানুয়ারির দুপুরের দিকে আমার জ্ঞান ফেরে। এখন , বুঝতে পারি , জ্যোতিষীবিদ্যা একটু আধটু চর্চা করি , বলেই , বুঝতে পারি , মঙ্গল – কেতুর কনজাংশনই এসবের জন্য দায়ী। ১১) প্রত্যেক কবিকেই তার পূর্বসূরীদের ঐতিহ্য , দোষগুণ , হতাশাবাচকভঙ্গী , সবকিছুই , অন্যূন এক শতাংশ হলেও রক্তে , মেধায় ধারণ করতে হয়। অশরীর চলাচল হয়তো এভাবেই শুরু হয়। তা না হলে , সে এগিয়ে যাবে কী করে? ঐ অশরীরীরাই হয়তো , কোন কবির ক্রোমোজমে লুকিয়ে থাকে , দৈবনির্দেশে। কবিকে তারাই চালায় , তাকে কেউ কেউ ভুল করে তাড়িত হওয়া বলে থাকে।
জন্মপত্র
আমি সমরজি সিংহের অস্তিত্ব তুলে ধরেছি , বিশেষ বিশেষ কয়েকটি জায়গায় “under-line” সহ। তার কবিতাভাবনা , বেঁচেথাকা ও পরিপার্শ্ব নিয়ে চিন্তাভাবনার বিশেষ কয়েকটি অংশও , সংখ্যাবাচক শ্রেণীতে বিন্যস্ত করলাম।
নতুন অনুভূতির স্পন্দনময় ভাষাজগত , যা চিরন্তন আবার ক্রমশ অভিজ্ঞ হয়ে ওঠা শিল্পীর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে চিরভ্রাম্যমান , তাঁর ধারাবাহিকতা আমরা দেখতে পাই , যদিও কবিতাটি , ততটা , ওপেন এন্ডেডনয়। একজন মানুষের ব্যক্তি অনুভূতির বাঁক , সংস্কার এবং পরজন্মের বিশ্বাস , জ্যোতিষ চর্চা ও অলৌকিক অস্তির শূণ্যতাবাহী নিশিরূপ আর যুক্তির অতিরিক্ত কোন রহস্যময় বিমূর্ত ইঙ্গিতের প্রতি আকর্ষণ কবিকে টেনে নিয়ে যায়। ননভিশন সমস্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে থেকে আমিকে সরিয়ে দেয়। যেখানে কোন স্টেক থাকেনা। সময় সম্পর্কে অতীত অভিজ্ঞতার ভ্রান্তি আর সংশয় থেকে অতিক্রান্ত হয়েই কবি এগিয়ে যান নতুন প্রকাশ ভঙ্গিমার দিকে। চেতনা তাকে চালিত করে , ‘conscience’ তাকে শেখায় শিল্প বিপ্লবের প্রোডাকটিভিটি ও পুঁজির রিটার্ন গোনা ছাড়া সময়ের মূল্য বেকার। আর তাই অধুনান্তিক সময়ে ‘ আমি ’ কবির প্রতিস্ব নয়। আধুনিক চিন্তার আমি , পাঠবস্তুর আমি যে – সততই – বারংবার পাল্টাচ্ছে , তা কোন এক সাবজেকটিভিটি দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। আর বিষয় কেন্দ্রিক নয় বলেই , বহুত্ববাদী আজগের ‘ আমি ’ সুনির্দিষ্ট অনুশাসনের বন্ধন থেকে মুক্ত।
আর এই ভাঙ্গা চোরা , ছোটবড় , আয়নায় , আমি’র বহুত্বকে খোঁজাই গুরুত্বপুর্ণ। সারাদিনের পর অদ্ভুত নীলচে লালরঙ যে ঘরে ঢোকে এবং এক বিক্ষত , মিশ্র অনুভূতিময় ব্যক্তির সত্ত্বাকে তার ইতিহাস , ভূগোল , ধর্ম , রাজনীতি , বিজ্ঞান , দায়িত্ব , সংসার ভাবনা , মৃতদের দীর্ঘনিশ্বাস , আজান , রাষ্ট্রীয় অনুশাসন , মূক ও বধিরের মুহূর্ত , অর্জুনী্নক্ষত্র , সন্ত্রাসভীরু জৈবউল্লাস , দ্রোণকলস , অস্পষ্ট , আধিভৌতিক কুয়াশা , ছদ্ম যাদুঘর , মাকড়সার লালা , চাঁদমারি , নোনাহ্রদ , সুড়ঙ্গের শেষ প্রাচীন কবর , ধোঁয়া ওঠা ইতিহাস থেকে অতৃপ্ত যৌনতার মুন্ডহীন ত্রস্ত অনুল্লেখিত বিচিত্রগামী বহুমুখী ক্রমশ একা হয়ে যাওয়া , মুদ্রাদোষে আলাদা হয়ে যাওয়া , চির পিপাসাগ্রস্ত আমিকেই কুচিকুচি করে ছড়িয়ে দেয় এক কাল্পনিক অভিজ্ঞতার জগতে। যেখানে ধর্মযাজক বা সমবেত জনতার চিকার নেই , নেই আমাদের কমরেড নিখিল লস্কারের কথা , যিনি বিপ্লবী থেকে , ক্রমে ভাঁড়ে রুপান্তরিত হয়েছিলেন।
প্রতিভাবনা , প্রতিকবিতা , প্রতিচেতনা থেকে  বহুকবির মৌলিক ও নিজস্ব পথচলা শুরু হয়। সমরজি সিংহের  কবিতায় অনেক দায়দ্ধতা আছে , আছে দ্বিধা , দ্বন্দ্ব , সময় নিয়ে ভাবনা। তার আধুনিকতা যেমন অস্বীকার করাও যায়না , ঠিক তেমনি ক্রমপরিবর্তনের চূড়ান্ত রেখা এখনও ততটা পূর্ণ নয়। আশি’র জহর সেনমজুমদার কিংবা পঞ্চাশের রঞ্জিত সিংহ , চল্লিশের রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরীর লেখায় আমরা দৈব , রহস্য , আধিভৌতিকতা , ভয় , তীব্র প্রেমহীন যৌনতা , নিরাপত্তাহীনতার সুস্পষ্ট গূঢ় চিহ্ন গুলি দেখতে পাইতবুও এদের লেখার বহুরৈখিকতা এবং নতুনত্ব আজ আর অস্বীকার করা যায় না। যদি কেউ সন্দেহ করেন , তবে সেটা হাস্যকর , প্রলাপকথন বা বাতুলতা মনে হয়। সমরজি কিনা , সেটা জানাবার মত তাত্ত্বিক , ক্ষমতাবান বা পন্ডিত আমি নই। শুধু এ’ টুকুই বলার , একপেশে , নির্দিষ্ট , “মধ্যবিত্ত ভালমানুষের ছা” না হয়ে বখে যাওয়ার বড় প্রিয় বৈচিত্র’ তার মধ্যে ষোল আনায় আঠারো আনা। যা মৌলিক ভাবনার অ্যামবাসক্যাডার , স্পর্ধিত , বেহেড করে। যদিও স্রেফ কারুর সন্দেহের চোখ...