প্রকাশক – কবিতা পাক্ষিক
ধূসর জিপসি বৃষ্টি রিক্সা
কবি : ধীমান চক্রবর্তী
ধূসর জিপসি আমার চোখে ভার্স কোরাস
ভার্স রূপে প্রতিফলিত হয়েছে। কোরাস অংশটি দ্বিতীয় পঙতির, যা প্রথম ও তৃতীয় পঙতিটির
মধ্যে সারা বই জুড়ে সংযোগ রক্ষা করছে এবং নতুন বক্তব্যের প্রতি তার ঝোঁক। প্রথম ও
তৃতীয় পঙতি আমার চোখে ভার্সের দৃশ্যমায়া। “সময়” সিরিজে অবক্ষয়, মৃত্যু, জন্ম,
নাগরিকতা। পুরাতন ও মৃত্যুর সফেনশ্বাসে দেখি ‘সময়ের এই টুকরো শ্মশানে/ একটাও
মাকড়সা নেই।’ পান্ডুলিপি ধূসর বীজের সাথে। কোরাসে জন্ম ‘মৃত্যুর পর শুণ্য থেকে
জন্মাই/ মা নেই/ কোনও বাবা নেই আমার’। কেউ কেড়ে নিতে চাইছে মানুষের ভাষা। ‘পাখির
তরল শব্দ মেঘ’, ‘নীল কাতড়ানি’ মানুষের ‘নৃত্যময় ঠোঁটে’। কোরাসে দেখি ‘এখানে কোনও
সর্বোচ্চ শক্তি নেই'। বইটি জুড়ে জোড়শব্দের এক অভাবনীয় প্রয়োগ রয়েছে। ‘হ্যারিকেন
ধ্যান’, ‘শক্তিমিনার’ – এইরকম অজস্র ব্যবহার চেতনার নতুন মাত্রার জন্ম দেয়।
‘ক্রাচে ভর দিয়ে এগিয়ে আসছে সাপ’, কেন জানিনা বিপ্লবের গান গায়। ‘জগৎ পাপড়ি’, ‘কমলা আঙটি’কে নির্দিষ্ট সময় অন্তর জ্বালিয়ে এর আগে কেউ তোলেননি।
এক আশ্চর্য পরাজয় বোধ – ‘এক দৃষ্টে আজ তাকিয়ে থাকা ডানা মুড়ে’। যৌনতা, স্মৃতির
সাথে অক্ষমতা – জঙ্গলে গর্ত খুঁড়ে বাক্সের মধ্যে থেকে/ তুমি বার করলে বালিকা বিদ্যালয়,/ গণিকাপথ
পরমাণু ঘূর্ণি লাগায়/ মুখোস পরা মহা জগৎ/ নগ্ন সংকেত গান’। অন্ধ মুখ আসলে পাথর, প্রাণহীন, যার দিকে কাচগ্লাস ও জন্ম
এগিয়ে যায় সামাজিকতা, মূল্যবোধ বজায়
রাখতে, কারণ, ‘ক্লোরোফিল গর্ভকোষ ছেয়ে গেছে বসন্ত গুটিকায়’। ‘মেষলোম’ ও
‘বন্দীশিবির’ – এর শব্দমূর্ছনায় কড়ি ও কোমল কবির সিগ্নেচারে পড়ে। পরিচিত দৃশ্য
অন্য মাত্রা পায় যখন দেখি – ‘এখন জগৎ কল্প জলাশয় থেকে/ শুষে নেয় রক্ত’। সময় – ছয় এর তৃতীয় স্তবক বা দ্বিতীয় ভার্সের
নাগরিক ছবির সাথে বিমূর্ততায় দেখি ‘এই সাদা রেকাবীতে/ আরোও সফেদ স্ফটিক হাড়/ কে
যেন রেখে গেছে ব্রহ্মান্ড কুন্ডলী/ নুড়ি স্নান পাতাল ঝুমকো’। ‘বৃষ্টিদান’ কবিতাটি
সময় সিরিজের উত্তরসুরী। হিংস্র শূণ্যতায়, ‘ যে আঁচড়ে দিয়েছিল মুন্ডহীন/ মেয়ের চুল,
দীর্ঘ/ শীত থাকায় সে তিনমাস হেঁটেছে দরফ নদী দিয়ে’। কোরাসে পাই ‘সময় বলে কিছু হয়
না, এক/ সম্পূর্ণ আলোড়নের নাম দেওয়া হল –
অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত’। ‘বৃষ্টীদান’ এর শেষ ভার্সে জন্ম দৃশ্যের পর তীর্থক
ধীমান সুলভ শব্দ প্রয়োগ, ‘তখন কোথায় খুঁজছে বৃষ্টিদান, ভেলভেট ঘাসে/ উপর হওয়া
রামধনু বিড়াল/ মহাকথা ঘুঙুর পরিক্রমা/। ‘নৌকোজ্যামিতি’তে নতুন জন্ম আসে, দুধপর্দায়
লেগে/ থাকা কিছু বাগান যা ছোট হতে হতে বীজ, এক একটা হয়ে/ উঠল আপেল মগজ
নৌকাজ্যামিতি’। এবং এই কবিতার কোরাসে সেই বিখ্যাত উক্তি ‘কাল পরম্পরার সঙ্গে কোনও
সম্পর্ক নেই সময়ের,/ আমাদের ধারণা ও কার্যক্রমের মাঝখানে শুয়ে আছে সময়।/ টিন – সৌন্দর্য
মাখা কয়েকজন/ মহিলাবীথিকায়, শিশু হাসে নীল গান/ জন্ম অধিক্যতায়, চুমকি ছররা ছাপিয়ে
আলগা বৃষ্টি’। - এখানে জন্ম ও প্রকৃতির এক অদ্ভুত সংকেত। কবিতায় দৃশ্যান্তরের
দ্রুততা – ‘পুরোহিতের শিং নড়েচড়ে ওঠে,/ থাইয়ে দাঁত দিয়ে আঁচড়ে দাও/ হাসি – উৎস/ নয়ানজুলি বানভাসি স্কার্ট জেগে
ওঠে। ‘পার্বণটিলার’ এই সিনেম্যাটিক প্রকল্প উস্কে দেয় ‘মানুষ সবদিক থেকে
স্বয়ংসম্পূর্ণ/ তাই আগামীকাল বলে/ কিছু নেই, কোনও চিন্তা বা দুঃখ প্রণালী/ নেই
আমাদের’ – এর মত কর্তৃত্ববাদ বিরোধী নতুন বক্তব্য। ‘কঙ্কালসুর’ – এ পাই সমসাময়িকতা
– ‘খবর-কাগজ ও সূর্যগ্রহন থেকে,/ সংঘর্ষ তুলে এনে তাদের সাথে/ কথা বল একজন
নাগরিক’। ‘ধূসর জিপসি’তে নষ্ট জন্ম – ‘ভয়ের/ চারপাস ঘিরে পৃথিবীতে পাড়া শেষ ডিমে
রান্নাঘর হাসি,/ টোকা দেয় শর্ষেপেয়ালা আকাল শিঙায়’। ‘রূপো মিনার’ এ পাই নাগরিকতার
নতুন ছবি – বৃষ্টি পাঁচতলা ছাঁদ থেকে/ মুখ বাড়িয়ে পান করে কংক্রিট/ রাধাচূড়া ফুল,
ছোট্ট চড়াই’। ‘মোম শৃঙ্গার’- এ অসাধারণ ভাবে শহরের ছবি, ‘নক্ষত্র গুচ্ছের বদলে এই
শহর/ সাজানো হল বহুতল বাড়ি/ খোলা জানলা ও অফিসবাতি দিয়ে’। প্রেম খুঁজে পাই
‘চাবিইন্দ্রিয়’তে যখন পড়ি – ‘যে অন্ধ শিশু মুখস্ত করে/ মেয়েটিতে স্ফটিক নক্সা’।
‘দংশন মেঘ’-এ সম্পর্কের গতিপথ বেজে ওঠে – ‘বেহালার শব্দে ডোবে বাড়ি/ সেতু টেনে
তোলে কলকব্জা লাগা/ মুখ পারিবারিক চলন ভাস্কর্যে/ দংশন মেঘ ঘিলু সূত্র’।
‘বৃক্ষস্মৃতি’তে শ্মশান দাহ আসে – ‘সেখানে তো তবু আলো পাও চিতা মস্তিষ্ক থেকে,/
রূপসী বৃক্ষস্মৃতি’। এ ভাবে মৃত্যু, চিন্তা ভাবনা, স্মৃতি, প্রেম, ধ্বংস কোলাজের
মাধ্যমে অরূপে বেজে ওঠে। ‘ঝিল্লিচোখ’-এ ফ্যান্টাসির উড়ান হয় যখন পড়ি – ‘জলকণা লক্ষ্য
করে ছুঁড়ে দেওয়া/ পাথর নেমে এল অন্ধ মাছের গুহায়’। ‘রাত মুখোস’-এ চেতনা সম্প্রসারণের
অভিজ্ঞতা ঘটে, যখন দেখি – ‘আস্তে আস্তে / বাঁধন খুলি চোখ ভূমি বেডরুমে,/ এগিয়ে আসে
সাইরেন লেজারমঞ্জরী’। লেজারের ব্যবহার বারবার ফিরে এসেছে এই গ্রন্থে। ‘শৈশব
সেলাই’-এ স্মৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গের একটা উদাহরণ হল, ‘তাকাই/ পেঁচানো আলোয়, অতীত
ফোয়ারায় দেখি চ্যুইংগাম চিবোতে চিবোতে/ মাঠ দিয়ে দৌড়ে আসে/ পৃথিবীর যাবতীয় শৈশব
সেলাই’। ‘হুইশিল উপত্যকা’-এ জেগে ওঠে ‘শষ্যক্ষেত’, ‘গ্রীষ্মআঁখি’ স্তনের আলোয়।
আলোর আগে স্তনের ব্যবহার দৃশ্যটিকে অন্য মাত্রা দেয়। ‘সূর্যচিত্রকর’-এ ভালোবাসা
বেজে ওঠে যখন পড়ি ‘মদরঙা প্রজাপতি ক্লিপ/ থেকে ডানা খুলে নিয়ে সোনালী/ ট্রাক্টরে
আঘাত করে জ্যামিতি চুম্বন’। মিথ, বর্তমান, কল্পনা মিলে যায় যখন দেখি ‘প্রিয়
বিশ্বাস আমার ৪’-এ যখন ‘উপুর হওয়া রিক্সা জমাট ছায়াটানেল/ টেনে নিচ্ছে তাকে
ফণানির্যাস –এ থাকা যোনিনৌকায়’। এখানে সে বলতে অশ্বমেধের ঘোড়াকে বলা হয়েছে যার
উপস্থিতি সম্মোহনের ধাঁচে বারবার ফিরে এসেছে এই গ্রন্থে। দৈনন্দিন চলাফেরাকে অরূপ
করতে পারলে কিভাবে ভীতি, কৃষ্ণনগর, যৌনতা মিলে যায় তা জানা যায় ‘এরিয়েল লিঙ্গ’তে –
‘নক্সাকাটা শামুক চলন যে/ প্রতিধ্বনি রেখে যায়, তাতে শিউরে/ উঠে তুর্পুন লুকিয়ে
ফেলে ভগবানে/ বিশ্বাস করা ছুতোর মিস্ত্রি, এবনহ নভোবিজ্ঞান বোঝার আগেই/ জড়ানো চোষক
পেটিকায় এসে/ নামে এরিয়েল লিঙ্গ হাড় মহল। এইভাবে চেতনা বক্তব্য, রাজনীতি,
সমসাময়িকতা একটি সম্পূর্ণ দৃশ্যঘর তৈরী করেছে ‘ধূসর বৃষ্টি জিপসি রিক্সা’য় নতুনের
প্রতি বিশ্বাস রেখে, অজানা জগতে আলো ফেলার আশায়।
খনিজ কবিতা
(প্রবীর রায়ের কবিতা সমগ্র১-এর অন্তর্ভুক্ত একটি কবিতার বই
প্রকাশকঃঃ এখন বাংলা কবিতার কাগজ )
শব্দের সাথে
মিশে যাওয়া যন্ত্র শব্দের পবিত্র ধারণার হেজিমনির বিরুদ্ধে বুকুর নষ্ট শরীর তুলে ধরছে
বলাৎকারে অথচ চিত্রনাট্যটি শুধু নতুন করতে পারতো টাইপ
মেশিনকে,দীর্ঘশ্বাস আঙুলে।
আমরা কবিতার
আত্মজৈবনিক ধারণার বিরুদ্ধে হাঁটছি নতুনের আলোয় এবং শীতকালের প্রচলিত কথা বদলে
যাচ্ছে বুকুর ফাটা আঙুল এবং রুক্ষ গোড়ালির সাথে,আমরা দেখছি ভালবাসা ও বিপ্লবের
বিপন্ন সিম্ফনি ও সমৃদ্ধি কেড়ে নেওয়ার পর নেশা,নারী একাকার। নেশা শুষে নিচ্ছে বুকুকে,সমুদ্র
থেকে আসছেন মৃত্যুর মসিহা।এক আশ্চর্য ক্রোধ উৎসব ও আলোর
বিরুদ্ধে।থিম ভাঙছে।পুরনো রোমান্স মুছে যাচ্ছে বাস্তবের কঠোর জমিতে।অথচ আমাদের
প্রচলিত ধারণা ও অভ্যাস বদলাতে চায় না এবং পাথরকুচি ও দাঁতের তফাৎ
থাকে না,রীতি বদলে যায় সুবিধার অজুহাতে,মোহের অভ্যাস বদলায় না।আমাদের কোথাও যেতে
হবে অন্ধকারে এবং দৃষ্টির অস্থিরতা ও স্বাভাবিকতা হারিয়ে যাবে পথ চলায়।এক অজানা
ঘাতকের জন্ম হচ্ছে অবাঞ্ছিত ভালবাসা থেকে।যা বদলে যেতে পারতো অথচ বদলাবে না এক
পূর্বনির্ধারিত ক্ষমতার কৌ্তূহলে।এই ক্ষমতাই আমাদের সতর্ক করার ভান করে সুবিধাবাদী
হরফে এবং রং শুষে নিচ্ছে সে,বাস্তবতার চিহ্নগুলো খুলে ফেলছে পোশাক।
এই
ধ্বংসছবির পর আমরা মুক্তির কথা ভাবি,জন্ম দিই নশ্বর আন্দোলনের।আমাদের শরীরে স্মৃতি
ছাড়া আর কিছু নেই।শরীর জুড়ে কর্তৃ্ত্বের স্মৃতি এবং আমরা জানছিঃবাদামী জুতোর দু
জোড়া দিব্যি চোখ/পলক ফেলল/নাইলন মোজা পেটে নাচতে নাচতে--।।এইরকম যার-ই চোখ সেই
ভুলে যাচ্ছে অভ্যাস।আমাদের পথপ্রদর্শকের বিশ্বাসঘাতকতায়ঃ
এইসব ঘটনার
পর/ভেঙেযাচ্ছে
কালো রাস্তার চওড়া/সবুজ আলোয় অন্ধকার মাখিয়ে/ দিচ্ছে কেউ।প্রবীর রায়ের এই
চিত্রনাট্য অতি মিত ও সাংকেতিক কথনে আমাদের অপরাগতা,প্রেমহীনতা, আত্মসমর্পণ জানিয়ে
বলেঃখনিমুখে আর উঁচু কযলার পাহাড় দেখে/আমরা বমচিকি গান গাইবো/সারা শরীরে ব্যান্ডেজ
বাঁধা দু একজন/তখনও চেঁচিয়ে বলবে।