‘হিট করে নি’
কবি তপেশ দাশগুপ্ত-র তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ । ১২০ পাতার এই দীর্ঘ
কাব্যগ্রন্থটিতে সংকলিত হয়েছে প্রায় ২৫০ টি কবিতা । কবিতাগুলির অধিকাংশই নাতিদীর্ঘ
। এমনকি দুই তিন বা চার পংক্তিতেই শেষ হয়েছে অনেকানেক কবিতা। ফলত অনেক কবিতাই
লহমায় পড়ে ফেলা যায়। অথচ প্রত্যেকটি কবিতাই যে মায়াময় আবেশ মস্তিষ্কে ছড়িয়ে দেয় তা
কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে দীর্ঘস্থায়ী । এবং একটি কবিতা পড়ে ফেলার পর পরবর্তী
কবিতাটি পড়ার আগে বেশ কিছুটা সময় আতিবাহিত হয়ে যায় সেই মোহময়তায়।
লক্ষ্য
করি , কবিতাগুলিতে আশ্চর্য দক্ষতায় কবি মিশিয়ে দিচ্ছেন এক মৃদু কাহিনী নির্ভরতা।
এই কাহিনীর আভাস অনেক ক্ষেত্রেই কাব্যগুণকে দুর্বল করে দিতে পারে । কবি তপেশ দাশগুপ্ত
সেই ফাঁদ বহুলাংশেই এড়িয়ে গেছেন তাঁর কবিতার পরিসরে(সে যত ছোটোই কবিতাটি হোক না
কেন) এক বিশেষ নিষ্ক্রিয়তার প্রবেশ ঘটিয়ে। ফলস্বরূপ নির্দিষ্টতা নয় , বরং এক
রহস্যময়তা ঘিরে থাকে কবিতাগুলিকে। যা কবিতাগুলির সৌন্দর্য বাড়ায় বহুগুণে।
‘শিলালিপি’ শিরোনামের ৩-পংক্তির একটি কবিতা এইরকম- ‘ফোন করছি /আর এসে আয়নায় মুখ
দেখছি / ফুটে উঠছে অক্ষর’। কিংবা ‘পূর্বাভাষ’ কবিতাটি এই রকম-‘তুমি আকাশ দেখে
অনেকরকম বলেছ/ মেলেনি সে সব/ আজ ঘুড়ির কথা বললে’।
নির্ভার
এই সব কবিতাতে নানান আঞ্চলিক শব্দও ঢুকে পড়ে সহজাত ভঙ্গিতেই । কবিতাগুলির মূল গঠনে
কোনোরকম বিচ্যুতি ছাড়াই এইসব ‘শব্দ’ অজানা
প্রলুব্ধতার ইঙ্গিত বয়ে নিয়ে আসে। ‘খড়িয়ার লোক অনেক শুনেছি /জলপাইগুড়ির অনেক
লোকেরাই বলে / আমরা খড়িয়ার লোক / খড়িয়ার মানে কেউ ঠিকমতো বলতে পারে
না’(‘হাতছানি’)কিংবা ‘আমরা ছুটতে ছুটতে / কখনো বৃষ্টি কখনো রৌদ্রের মধ্যে/জন্মান্তর
দেখতে পেয়েছিলাম/ ডাউয়া তলায় অজস্র ডাউয়া ছড়িয়েছিল’(‘বাবুলের সাথে’)- কবি অত্যন্ত
সচেতন ভাবেই খড়িয়া বা ডাউয়া প্রভৃতি শব্দকে কবিতাগুলির প্রাণকেন্দ্রে স্থাপন করেন
তা লক্ষ্য করি। কবিতা পাঠের ঔৎসুক্য বাড়ে এই প্রায় অচেনা শব্দের
মেদুরতায়।
একই সঙ্গে তাৎক্ষণিক কিছু চলমান দৃশ্য অথচ তেমন বিশেষ কিছু নয় , যা সহযে নজরে আসতে পারে-
এমনই তুচ্ছ সব ক্রিয়াসমূহ প্রাত্যহিকতার মধ্যে থেকেই গভীর কাব্যগুণে ধরা দেয় তপেশ
দাশগুপ্তের কবিতায় । পৃথিবীর ছায়াতল পুনরাবিষ্কারের মতোই আনন্দ আসে সেই সব কবিতা
পাঠে। এ প্রসঙ্গে ‘রোববার’ কবিতাটি উদ্ধৃত করি- ‘আজকে আকাশ খুব নীল / গাছের পাতারা
সবুজ/ সূর্যের আলো মিঠে / পিঠে ব্যাগ নিয়ে আঁকার স্কুল থেকে ফিরছে আমার মেয়ে’।
মাত্র পাঁচ পংক্তির এই কবিতায় অপার সৃজন ও
স্থাণু নৈ্সর্গিকতার ছায়া । আর সেই স্থির চিত্রের মধ্যে কবি শেষ দুই পংক্তিতে হঠাৎই এনে ফেললেন এক অসীম চলাচল। মন ভালো
হয়ে যায় এই রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালে। মন খারাপের ক্ষণও আসে।। যদিও দ্রষ্টব্য , কবি
তপেশ দাশগুপ্ত শোকগাথায় কোথাও বিলাপের অস্থিত্ব রাখেন না। ঝাপসা চোখ মুহূর্তে
সচকিত হয়ে ওঠে, গতির সন্ধান করে আবার হয়তো বা থমকেও যায় কিছুটা। কবিতা পড়তে পড়তে
থমকে যাই আমিও- ‘আঠাশ বছর ছিলাম/আঠাশ বছরের কোনো স্মৃতি নেই/মানুষের আঠাশ বছর খুব
সুন্দর হয়’(‘চলতে চলতে’)।
অপসৃয়্মান
রোমান্সের রেশ কাটতে না কাটতেই পড়ে ফেলি কবির আরেকটি চার পংক্তির কবিতা। ‘চুল কেটে
এসে/ তোমার সামনে কুৎসিত হয়ে দাঁড়াই /
চেয়ে থাকি অপলক/ তোমার দিকে’ (‘স্নায়ু নেই’)- কী বলব একে!
অ্যান্টি-রোম্যান্টিক নাকি প্রতিস্পর্ধী প্রেমের কবিতা ! না কি সেই প্রাচীন প্রবাদ
যা জানায় , কবিরা প্রত্যেকেই আসলে নিজেদের সঙ্গে এক সন্দেহপ্রবণ আততায়ীকে বয়ে নিয়ে
বেড়ান- তাকেই মান্যতা দিলো এই কবিতাটি। কবি হাজির করলেন সেই মুখ যা একই সঙ্গে
করুণাপ্রার্থী ও তীব্র হিংস্র। এই কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করতে করতে টের পাই পাঠক
হিসাবে প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠার কথা। সেই সব বিচ্ছিন্ন সরল অনুভূতি , ওঃ! ফিরিয়ে দিচ্ছেন
আবার কবি তপেশ দাশগুপ্ত। আবার বলতে হয় প্রাত্যহিকতার সেই তুচ্ছ বিষয় সমূহের কথা যা
অনেকক্ষেত্রেই আমাদের নজর এড়িয়ে
গেছে হয়তো।‘লাইন পেরোলে নাসেরের
বাড়ী/ পৌঁছতে পারি না/ ঘুড়িগুলি কেটে ওদিকে চলে যায়/ হাওয়ায় উড়তে উড়তে / নাসেরের
মা কলমি কুড়োতে কুড়োতে/ ঘুড়ি ধরে নাসেরকে দেয়’(‘মাঠের রোদ্দুর’)।
এই
পরিসরে কাব্যগ্রন্থটি থেকে মাত্রই কয়েকটি কবিতা উদ্ধৃত করা গেল। যদিও পাঠকেরা ১২০
পাতার এই দীর্ঘ কাব্যগ্রন্থে অন্য অনেক এমন কবিতা খুঁজে পাবেন যা গোপন ও আশ্চর্য
সব উৎস। গভীর ও হৃদয়স্পর্শী। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন জলপাইগুড়ির ‘এখন বাংলা কবিতার কাগজ’ –এর পক্ষে যৌথ ভাবে প্রবীর রায়
ও অতনু বন্দ্যোপাধ্যায় । প্রচ্ছদ ও মুদ্রণ চমৎকার । হার্ডবাউন্ড এই কবিতার
বইটি পড়ে ফেলে অনুভব করি আমার চশমার কাঁচ স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। আর থেকে যাচ্ছে এক
বিশাল বনের আড়াল। আমার চোখেমুখে।
হিট করে নি
তপেশ দাশগুপ্ত
এখন বাংলা কবিতার কাগজ
মূল্যঃ৬০ টাকা