“পসিবিলিটি ও টিলিবিসিপ” নিয়ে দু-চার কথা / নীলাব্জ
চক্রবর্তী
কবিতা কোথায় থাকে? আমাদের
জীবনযাপনের কোথাও একফোঁটা কবিতা লেগে নেই। আর আমাদের জীবনযাপনের
সর্বত্র মিশে আছে কবিতারেণু। আর, হ্যাঁ, আগের
আপাতবিরোধী দুটো বাক্যই নির্ভেজাল। কবিতার আলোচনায় চলে
যাওয়ার আগে ভূমিকা হিসেবে এইটুকু মেনে নেওয়া যাক।
তরুণ কবি সব্যসাচী হাজরার
তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পসিবিলিটি ও
টিলিবিসিপ’ সবে প্রকাশ
পেয়েছে। প্রকাশক ‘এখন বাংলা কবিতার কাগজ’-র সুযত্নের ছাপ লেগে আছে বইটার আগাপাশতলা।
পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সব্যসাচীর আগ্রহ ও নৈপুণ্য বোঝা যায় বইটির নামকরণ থেকেই। ‘পসিবিলিটি’-কে ওল্টালেই ‘টিলিবিসিপ’। প্যালিনড্রোম নাম
এ বইয়ের, অর্থাৎ উভমুখী। লক্ষ্য করি, বইয়ের
গোড়াতেই ‘পসিবিলিটি’ অর্থা সম্ভাবনা-কে উল্টে
চলে যাচ্ছেন কবি আর বেড়ে যাচ্ছে পাঠকের অনন্ত প্রত্যাশার সম্ভাবনা। একটা
রসায়নাগারের কথা মনে পড়তে থাকে ক্রমাগত। এ ভুবন সব্যসাচীর নিজস্ব। বাজারমুখী
কবিতার সস্তা জনবহুল রাস্তায় না হেঁটে আদ্যন্ত ঝুঁকির নতুন নিয়ে ঘর করছে সে। গড়ে উঠছে তার
নতুন কাব্যভাষা। এ বই ভরসা জোগাবে আগামীর কবিকে। সেই নতুন পথে
এগিয়ে যেতে, খুঁজে নিতে আগামীর সুদীর্ঘ মাইলফলক।
ধ্বনি, ফর্ম, কনটেন্ট
সবেতেই সব্যসাচীর নতুন ভাবনাচিন্তার ছাপ স্পষ্ট। ব্যাকরণ,
মেণ্ডেলের বংশগতির সূত্র, ভূগোল এমনকি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ভাষার সাথে কবিতার
মিলন সম্ভব ঘটিয়েছে ‘কবিদের ক্লাস’ অংশে। ওই অংশেই, আসুন, একটু ছুঁয়ে দেখি সব্যসাচীর নির্মিত কাব্যনমুনা।
“সেদিনটা ছিল সেক্স-ব্যাঙ্ক
যন্ত্রের, যার ট্যানারিতে উড়েছিল ডাহুকেরা ... গার্ডার নিয়ে খেলতে খেলতে কুকুরের
মুখ থেকে পড়েছিল দুফোঁটা পৃষ্ঠটান ... মূল মধ্যরেখায় তার ফসল ফলেছিল বেবিগার্ল,
নাম, গ্রীনিচ... আমি শুভেচ্ছা জানাতে ভুলিনি।“
এই উচ্চারণ আরও কবিতার উৎসমুখ যেন খুলে দিলো। হাট করে দিলো পাঠকের হাজারদুয়ারী চিন্তাভাবনা। এটাই এই কবিতার সবথেকে বড়ো
ম্যাজিক। সব্যসাচীরও।
অথবা
“বীনাতুর দিয়ে যতদূর দেখা যায়
তাতে গিনিপিগগুলো সাবান কাচছে শ্রাবণের পর... চাঁদ বড়ো হলে চানাচুর পায় শিশুদের...
কবিতাল্যাবের এই হোলো অসুবিধে, এই হলে “এখানে বিজ্ঞাপন মারিবেন না”, সবচেয়ে বড়ো বিজ্ঞাপন হয়ে
ঘোড়ায় ওঠে, ...”
আবার ‘পিওবানের মেয়েরা’ অংশে লক্ষ্য করি এক
নিয়ন্ত্রিত বুনোট, তারিফযোগ্য নির্মাণ।
“ গড়িয়ে নামুক স্বভাবজাত বক
ট্রিওপিয়ার স্তন থেকে
আমি রয়েড পার্কে হেঁটে নিওনিয়ার-সূর্য
দেখি
লিলিনসুরার সার্কাসে...”
এই খেলা চলতেই থাকে, চলতেই
থাকে। কোথাও কোথাও অনেকটা একইরকম লাগে ধ্বনিভিত্তিক স্ট্রাকচারাল বিন্যাসের
সাদৃশ্যে। মজার কথা, অধিকাংশ কবি যেখানে পরীক্ষানিরীক্ষায় লাগাম বেঁধে কবিতাকে একটা
স্বাধীন এনটিটি হিসেবে বাড়তে দেয়না, সেখানে সব্যসাচী লাগাম হাতে নেওয়াতেই বিশ্বাসী
নয়, মনে হয়। তার কবিতা মুক্ত, কবিতার সবরকম শর্ত পূরণ করে ফেলার পরও অনেকটা খোলা স্পেস
তার সামনে। তিনটে কবিতার বই হয়ে গেলো, আগামীতে আরও পরিণত সব্যসাচীর অপেক্ষায় রইলাম।
পসিবিলিটি ও টিলিবিসিপ
কবি – সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশক – এখন বাংলা কবিতার কাগজ
প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারি ২০১৩
মূল্য – পঞ্চাশ টাকা