69Th pOsT : জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের গল্পগ্রন্থ আলোচনা করছেন অভীক দত্ত


গল্পকারের ভবিষ্যৎ has
অভীক দত্ত

গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজোটা বেশ মজাদার ব্যাপার। মানে দেখবেন রবি ঠাকুরের জন্মদিনে সবাই রবি কীর্তনে লেগে পড়ে। ছোটবেলায় মনে আছে আমাদের অখানে একটা ছেলেকে স্টেজ থেকে নামিয়ে দিয়েছিল শুধুমাত্র সে পচিশে বৈশাখ রবি ঠাকুরকে নিয়ে স্বরচিত একটা পড়তে চেয়েছিল বলে। তা অনুপমদা বাকে যখন লিখতে বলল তখন অন্য কিছু ভাবছিলাম। হঠাৎই হাতে চলে এল জয়দীপের গল্পের বইটা। আদরের নৌকা থেকেই প্রকাশিত।ঠিক করলাম এই বইটা নিয়েই লিখব। লেখার দরকার আছে। সবার জানারও দরকার আছে। এবার বুঝলেন কেন গঙ্গা পুজোর কথা দিয়ে লেখা শুরু করলাম?
এখন বেশ নিজের ঢাক নিজে পেটানোর যুগ। নিজে একটা কিছু লিখে গুষ্টিশুদ্ধ লোককে ট্যাগ করাটাই লেটেস্ট ট্রেন্ড। আমি একে সমর্থনও করি। যারা নতুন লিখছেন, পরিচিতি  কম, তারা যদি প্রচার না করেন তবে তারা কিভাবে প্রচার পাবেন।
জয়দীপ যদিও এই দলে পড়ে না। একেবারেই অন্তর্মুখী। গল্প কোথাও দেয় টেয় না। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গল্প চাইতে হয়। প্রকাশনা যখন এই বছরের শুরুতে শুরু করার কথা ভেবেছিলাম তখন জয়দীপকে জানিয়েছিলাম। প্রথমে অনেক না টা করে শেষ অব্দি আমাকে ওর এগারোটা গল্প পাঠাল বইয়ের জন্য। আমাদের কলেজেরই ছেলে। কলেজ লাইফে ম্যাগাজিন বের করত আলাদা ভাবে। জয়দীপ বায়োটেক আমি কেমিক্যাল। কলেজ লাইফে সেরকম বন্ধুত্ব ছিল না। ২০০৭ নাগাদ কলকাতা বইমেলায় আদরের নৌকার স্টল দেবার সুত্রেই ওর সাথে আলাপ। কলেজ থেকে বেরিয়েও বহুদিন যোগাযোগ ছিল না। পরে ফেসবুক সূত্রেই আবার দেখা হল ওর সাথে। মিথ্যে বলব না বইমেলার তাড়ায় জয়দীপের বইয়ের পান্ডুলিপি আমার সবটুকু পড়া হয় নি। গল্পের বাঁধুনি বেশ ভাল,  সেটা বুঝেই ওর বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
বইমেলা পেরোল, ব্যস্ততা, বইয়ের হিসেব, মেলা শেষে দিনান্তে সোমরস ইত্যাদির মজা কাটিয়ে আবার যখন কাজে ফিরলাম,তখন হঠাৎই ব্যাগ থেকে বইমেলা কেনা থেকে বই বের করতে করতে জয়দীপের বইটা হাতে এল। পড়াটা আমার নেশা। এক অফ ডে-র দিনে শুরু করলাম জয়দীপের বই “প্রতিবিম্ব” পড়তে।
বেশ চমকে গেলাম। এ তো অন্য ঘরানার লেখা! জমাট প্লট, সুনির্বাচিত শব্দচয়ন এবং গল্পের গতি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকে গল্পের মধ্যে বেঁধে রাখতে শুরু করল। ১১টি গল্প। ১১টিই বিষয় বৈচিত্রে ভরপুর। এক কসাই এবং এক অনাথ ছেলের গল্প দিয়ে শুরু হয় বইটির পথ চলা। গল্পের নাম “দাগ”। গল্পের রাশ এবং বিশ্বাসযোগ্যতা কখনই হাত থেকে বেরতে দেননি গল্পকার। যেটা আমাকে বেশি টানল সেটা হল প্রায় দুহাজার শব্দের মধ্যে গল্পগুলি ঘোরা ফেরা করলেও ছোটগল্পের বৈশিষ্ট কখনই হারায়নি গল্পগুলি থেকে। সেই একটা অন্ধকার ঘরে একটা ছিদ্র থেকে যতটুকু আলো ঘরটিকে আলোকিত করে ততটুকুই ছোটগল্প।
জয়দীপ তার বইতে ঘুরেছেন টাইমলাইনে করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কিংবা তারও আগে। আছে নির্ভেজাল বন্ধুত্বের কিসসা কিম্বা গা শিরশিরে ভূতের গল্পও।“অবিশ্বাস্য”, “সব চরিত্র কাল্পনিক নয়”, “ঘষা কাঁচ”, “অতিবাহন” অথবা “খরস্রোতা” গল্পগুলি গল্পকার সম্পর্কে উৎসাহিত করে। অবিশ্বাস্য গল্পটির পরিবেশ বরদার বৈঠকি গল্পের আমেজকে মনে পড়ায়। মাঝে মাঝে গল্পের মধ্যে শরদিন্দুর প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তবে গল্পকার সযত্নে সে প্রভাব এড়িয়ে যেতেও সক্ষম হয়েছেন। কোথাও কোথাও তৎসম শব্দের প্রাবল্য লক্ষ্য করা গেছে। তবে তাও নিতান্ত গল্পের প্রয়োজনে। হাজারীবাগের পটভূমিতে “রুদ্ধদ্বারের ওপার হতে গল্পটিও মন ছুঁয়ে যায়।
মনে আছে বেশ কিছুদিন আগে আবেশ কুমার দাসের “বনলতার বিজন” বলে একটি গল্পের বই পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ধীরে ধীরে গল্প বুনে নিয়ে যাওয়া, ভাষার নির্বাচনে জয়দীপ খানিকটা আমাকে সেই সুখস্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।
গল্পকারের কাছে অবশ্য আমার কিছু অনুযোগ আছে। গল্পকার বেশিরভাগ গল্পেরই সময় নির্বাচন করেছেন একটু আগের সময়ে। আমি চাইব এই সময় নিয়ে গল্পকারের থেকে আরো বেশি বেশি গল্প।  কোন কোন গল্প অকারন দীর্ঘ হয়েছে, সেই জায়গাগুলোও আমি মনে করি দৈর্ঘ্য কমানো যেতে পারত।গল্পকারের কাছে আরও adult content এর আশা করি। বাংলা সাহিত্য জগত বড় শিশুসুলভ এখনও।  তবে  প্রচারবিমুখ এই গল্পকার ভবিষ্যতে আরও লিখবেন এবং আরো পরিচিত হবেন তার লেখার গুণে সে কথা বলাই যায়।

“প্রতিবিম্ব”, ১১টি ছোটগল্পের সংকলন, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়, আদরের নৌকা প্রকাশনী মূল্যঃ ১৯৯টাকা
প্রাপ্তিস্থানঃ flipkart.com, pothi.com, anarchive.in