66Th pOsT : অরূপ রতন ঘোষের কাব্যগ্রন্থ 'লং ড্রাইভ' সম্পর্কে লিখছেন সাঁঝবাতি



লং ড্রাইভ

অরূপ রতন ঘোষ
ওপেন সিক্রেট প্রকাশনী


ক্রমশ শব্দের ঝড়। কানের পাশ দিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে সা সার শব্দ। আলো, আলো, আলো।
কবিতা কবিতা একটা লং টানেলে একঝাঁক ধাবমানতায় তীব্র আলো ঢুকে আসে অন্ধকারের দিকে। তারপর...
অবনত রশ্মির সামনে যে ঘাটসেকশান, টানেল, আলো...
কবি অরূপরতন ঘোষ এইভাবে আমাদের হাওয়া-বাতাস উড়িয়ে নিয়ে চলেন লং ড্রাইভ-এ। সাথে ওড়ে গানের কলি, ফেলে আসা জীবনস্টপ আর যাবতীয় মূল্যহীণ মাইলস্টোন। ২০০৫-২০০৭ এর মধ্যে লেখা কবিতাগুলো শব্দের মানচিত্রের প্রতিটা বিন্দুকে নতুন করে চেনায়। এক এক জায়গায় অবাক করে তারাও বলে চলে স্বর হয়ে আছি
অখিলেশহীণ পেরিয়েছি মহাযান। কথা শুনে ভুলে গেছি স্নেহলতা নামে আত্মীয়সজন।
                         কখন সকাল বেলা... বাড়ি বেয়ে রোদ্দুর উঠেছে।

মোম গলে পংক্তিগুলো ঝরে পড়ে আমাদের হাতের মুঠোয়, যদিও কবি জানিয়েছেন বইটি আজ দুষ্প্রাপ্য। অত্রি বন্দ্যোপাধ্যায়ের যথোপযুক্ত প্রচ্ছদ সমন্বিত মলাট ছুঁলেই, লং ড্রাইভে হারিয়ে-যাওয়া-পথে পড়ে থাকা ঝরা পাতার স্পর্শ পাওয়া যায়। আর কবিতায়? পাওয়া যায় কোন এক মাইলস্টোনে হারিয়ে যাওয়া নামের- আত্মীয়তার ছোঁয়া, মুগ্ধতার স্পর্শ রেখে বাড়ি বেয়ে রোদ্দুরেরা কবিতার পিছু উঠে আসে, অরূপরতনের লং ড্রাইভ অবধি।
আমি জলে স্বীয় ছায়া দেখি, দেখি জল থেকে উঠে আসে ভিজে টেলিফোনস্বর। টেলিফোন
তারের ভিতর স্পর্শ রেখেছো। বিদ্যুতের চিহ্নমাত্র রেখে গ্যাছো তুমি। আর ঘাম হয়ে উড়ে
                      গ্যাছে অমিতাভ মানে বেতাব বাদশা।

অরূপরতন চেনালেন ফোনের এপাশের ঘর্মাক্ত শব্দদের, যাদের না-বলাগুলো টেলিফোনে নয়েজ এনে ফেলছে আজও। লং ড্রাইভকালীন অপরাধবোধে সমস্তই উপড়ে বেরিয়ে আসে ভিতর থেকে। বেতাব বাদশা উড়ে যায় যে তোমার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়, তার জন্যই আজ লং ড্রাইভ এই ভাগ্যরেখাক্লিষ্ট হাতে এসে পড়ে। ঠিক সমান দায় সেই রোদেরও যা কি না আরবী ভাষার চেয়ে শক্তসেই সব দূরযাত্রার দুপুরে উঠে আসে বইটি কোন এক সরাইখানা থেকে, প্রিয় মার্গারিটাকে অনাবশ্যক মনে করায়-
এমন কি দূরত্বগুলো মিশে যায় সফট কিচেনে
ঘরময় কর্ডের প্যান্ট, অতিক্রান্ত শব্দের গন্ধ

ওপেন সিক্রেট প্রকাশিত স্বল্পমূল্যের বইটির কিছু পংক্তি বিদ্যুতের মত আকাশ কেটে বেরিয়ে পড়ে, লুকিয়ে রাখার মতো রেকাব। লেখালেখি সমস্তই কেটে দেওয়ার মত। কবি বললেও পাঠকই একমাত্র এই অরূপরতনকে চিনে উঠতে পারেন। জুলাই ২০০৮-এ প্রকাশিত বইয়ের সর্বত্র কিছু স্যুররিয়ল স্বপ্ন লেগে থাকে, দূর থেকে ভেসে আসে তারা চলে যাওয়া ট্রেনের মতো,-
ও কি তারই শব্দ!
     যখন ট্রেন চলে যাচ্ছে
                                       এমন কি নদীর পাড় করবী ফুলের চেয়ে শাদা।।
-ভূমি
কবিতার বিষয়বস্তু শব্দায়ন কোনো বিশেষ সীমানায় পড়ে থাকেনি, তারাও যেন দূরের অভিযাত্রী হয়ে মাইলকে মাইল পাঠককে ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়ে। লং ড্রাইভএর কবিতার যাতায়াত সীমাহীণ, তবু কোথাও চিকের আড়াল থেকে তাকে দেখে যেতে হয় আমাদের জীবনের জয়তীদের মতো-
                                    যেন চাঁদ আলগা দিচ্ছে
                                                এমন গভীরভাবে পড়ে নিচ্ছো সিঁদুর।
                                                ছিটকালো লাল রং।
                                                ..............................
                                                এমন আতপের দিনে
                                                আমাকে সহ্য করো
                                                আমি এই সমগ্রতার অংশ হতে চাই।

কিছু কিছু সময় কবিতা পাঠককে বিমূঢ় করে রেখে দূরে হারিয়ে চলে যায়, অরূপরতনের কবিতায় এরকম দিকনির্দেশ হামেশাই মেলে,-
টাঙানো অঘ্রাণমাস জুড়ে স্যরি’’

কবির ভ্রমণকে সম্পূর্ন করে কবিতার বৃত্তগুলো শেষ হয়। কবি অরূপরতন পরীক্ষা নিয়ে চলেছেন কবিতায় কবিতার। তাই নতুন নতুন শব্দের মাইলস্টোন পার হয়ে এসেছে লং ড্রাইভ, তাদের মিলমিশে বেড়ে উঠেছে মোট কুড়িটি কবিতা যাদের মধ্যে অবাধ যাতায়াত ছক ভাঙা শব্দের। অনায়াস ব্যবহারের ফলে কবি-পাঠকের এই অ্যাডভেঞ্চারে তারাও একসময় উঠে এসে হাত ধরে।
                               দূরে মেহসিনা রং এর মতো বরফ পড়ে কিনা।
                                         এ রাত আলো পরবশ হয়
                                         দেখি, ভোর ফুটে গ্যাছে ট্যাকোমিটারে।
                                         পাহাড়ের ঢালে গুলির শব্দ-
                                         পুলিশ ঘিরে ফেলেছে শালের জঙ্গল
-হুইসেল
লং ড্রাইভ-এ দৃশ্যের অদলবদল, কবিতার ক্রমাগত সেটচেঞ্জের ফলে পাঠকের মনের সহজাত প্রশ্নের জবাব মেলে তখনই যখন জানা যায় কবির স্বল্প দৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র জিরো মাইলস এর নাম। বোঝা যায় কেন এতো ট্র্যাক বদল এক কবিতা থেকে আর এক কবিতায়। প্রতি কবিতায় কবির সাথে এসে বসেন এক চলচিত্রকার অরূপরতনও, যার চোখে সব দৃশ্যই শব্দ হয়ে যায়, সব শব্দই দৃশ্যের অ-রূপ ধরে। লোভ হয় কবির অন্যান্য লং ড্রাইভ গুলির সঙ্গী হতে, যার স্বাদ পাওয়া যেতে পারে অরূপরতন ঘোষের অন্য কবিতার বই মর্ত্যফেরিঘাট-এ। লং ড্রাইভ পড়ার পর লোলুপ হয়ে থাকা যায় এই বইগুলির জন্য, পথ চেয়ে থাকা যায় কবির উপন্যাস সূর্যহীণ হাতে পাওয়ার আশায়। এই অবসরে তাই দোসর হয়ে ওঠে-

                                  এই যন্ত্রের ভিতর
 সরল ও অভিসারী এক বিক্ষেপ ধরা পড়ে
                                             রং..
                                             বৃষ্টি.. ..
                                             আলো কমে আসার সময়
                                             তোমাকে আর্তি নাম্নী মহিলা মনে হয়।

-সাঁঝবাতি