56Th pOst : রাক্ষসজন্মের কথামালা ... তন্ময় মন্ডলের কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করছেন সব্যসাচী হাজরা



এভাবেই যোগাযোগ। এভাবেই বিন্দু বিন্দু , অতয়েব লালদীঘি। যেমন নদীরাও , তেরো কিনা... “রতনে রতন চেনে” , পরিচিত প্রবাদ , শুরু করা যাক । তন্ময় কে চিনলো বারীন , আমরাও বাজলাম , তবে শব্দটা “রিন্ রিন্” নয় , আরও গভীর , চোনাহীন আলো , যেভাবে চেনালো , কিছু কথা  , কিছু বিমূর্ত টেস্ট রক্তিম।

   শুরুতেই শ্রদ্ধেয় কবি বারীন ঘোষালকে ধন্যবাদ কবি তন্ময় মন্ডলের দৃশ্যপথ শিকার করার জন্যে , আমার একান্ত অনুভব , তাঁর কথামালা রাক্ষসজন্মের , পাঠকের চোখে দেবতার হাই আলগোছে খেলো , সম্প্রসারিত চেতনার ফল ফললো নতুন আঙ্গিকে , ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া , আঘাতের মধ্য দিয়ে সম্পূরক হোলো সহস্র বছর পর , এমনই শব্দ ব্যবহার ও তার প্রকাশ। মাপতাল ও বিপদসীমার বাইরে থেকে ভিতরে এলাম ও প্রথমেই আটকে গেলাম “রাক্ষস জন্মের কথামালায়” সিরিজ্-টি গোটা চল্লিশ ছোটো অংশে বিভক্ত , প্রতিটা কবিতায় চিন্তার অন্য জাগলিং,জাগতিক সৃষ্টি ও ধ্বংশের প্রতি ভিন্ন অঙ্গুলিহেলন ...
যেমন
“ খেলা করছে মহাকালবার।হিমলেপ।তরাই বনের পুংকরোটি নাড়তে নাড়তে হাজির হল।মেশিন লুমের ভিতর পিউপার দাঁত।মহানিমে বসে সে হুক্কা হু্যা করে কেশে উঠল।ন্যাড় মেখে, হলুদ বমির মধ্যে দানাশস্য সোর্ডফিশ হয়ে ঘুরে বেড়ায়...    তার প্রসব বজ্রসেগুনের মতো কেঁপে উঠেছিল।নাইকুন্ডলে শতেক আঠা মদ।... পাশে ষোড়শী। রম্য যোনি কাঁপানো নাচ পরবশ হাসিতে। ... ওখানে ফুটবল খেলা চলে।মায়া মাহুত-এর চণ্ড ক্রিকেট চলে। ... ”
                                                      (রাক্ষসজন্মের কথামালা)

সম্পূর্ন কবিতাটায় টর্চ পড়লে দেখা যায় কবির কল্পক্ষেত্রের জ্যাগড্ প্রজেক্শনে বিনাশ ও প্রলয়ের অন্ধকার মহাকালবার শব্দ ও তার ক্রিয়াকলাপের মধ্যে নিহিত। প্রকাশের স্বতন্ত্র্য আঙ্গিকে সেই আঁধারি নগ্নতা পাঠকের শ্রবণ ও দর্শনে এক নারকীয় জোন তৈরী করে যা কবির মানসিক-গ্রীস্মের দাবদাহ।

মিথ বা ডিমিথ করার তড়িক্ষেত্র না হলেও এক অদ্ভুত মায়া ,নিক্ষিপ্ত ইলেকট্রনের মত পাঠককে চার্জড করে।পৌঁছে দেয় নিজের জন্ম ও মৃত্যু-স্পন্দনের চীকারে। যেমন-
“বিপজ্জঙ্ক শুয়োর অবতার যতবার আমার খাঁচা থেকে
নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে তার ঘামতেল মাখানো
নাভির ঝুলকালি থেকে ব্রহ্মবালকেরা সাইকেল নিয়ে
উড়ে যায় তাদের টায়ারে আগুন মেশানো ছাল
ছড়িয়ে পড়তে থাকে প্রাতঃকৃ্ত্য...” 
                                                (বিপজ্জনক শুয়োর অবতার)



অথবা
“এই দেহকলের মধ্যে সিলিকনের দেওয়াল হাতড়ে নষ্ট
আত্মা দেখে নিচ্ছিল তার বেরুনোর জন্য কোথাও কোনো
চোরাগোপ্তা ফাঁক থেকে গেছে কিনা...”
                                                  (ইঃ আত্মা)

মৃত্যু ও জন্মের মাঝে সাইক্লোন , তার মাঝে নিজেকে বোনা ,এক অভিনব আয়ত্মের প্রকৃত সাজ।
এরকম ঘূর্নি ওঠে
“... তবু নররেফারীর প্রেতাত্মা কখনো রাক্ষসের কখনো বা তন্ময় মন্ডলের
   ছদ্মবেশ ধরে মড়া সেলাই-এর ছুঁচ নিয়ে পালিয়েছে বার বার
   যাও খুঁজে আনো সেই ছদ্মবেশ
   তবেই তোমার বিশ্রাম ধাতস্ত নরকে
   কল্পান্তকাল।
   কল্পান্তকাল।
   কল্পান্তকাল।“                                           (ছদ্মবেশ)
এখানে লক্ষ্য করা যাক , নরকে বিশ্রাম পেতে হলে কবি নিজেকে ধারণ করার কথা বলেছেন , এখানে নিজের জন্ম যেন রাক্ষসজন্মের সাথে মিলে , পাঠককে ওমনিডায়রেকশনাল নরকের এক ছবি উপহার দিয়েছে


“... হাড়িতে মুড়ো গলিয়ে , গলায় সীসার মালা পরে
   বাহান্ন তাস ভেঁজে আঙুরকে
   ভোরবাসে ইস্কুলে পাঠায় যেসব গেরস্থ ডাইনীরা
   তাদের শায়ার ফ্রিল ছিঁড়ে
   খনিঘুমে টাল খায় মিশরের তুতেন খামেন...”
                                                        (তুতেন খামেন)

শেষ দুটো লাইন ও তার বিন্যাসে প্রাচীন ও বাস্তব মিলে মিশে একাকার। কবিতার কর্তা তুতেন খামেন যে ভাবে পৌরাণিকতার খনি ছেড়ে সঙ্গমের অতলে নড়েছেন, তা প্রকাশভঙ্গীর সার্থকতা বলে স্বীকার করে নিতে হয়।


নরকে ঝুলুক স্বর্গের দূরবীন- একথা বলতেই স্বল্পসময়ে কবির কল্পলোকের হাঁ-গালে অনন্তরূপ দেখার সৌভাগ্য হোলো,  কোথাও শ্লোক-ধর্মী শব্দকল্প , কোথাও তন্ত্র , পুরাণ থেকে ঠিকরে বেরোনো অতিভোজী চেতনা জারিত হোলো
     “রন্তকের জিনে জিনে” ও “রাক্ষসের ব্যূহপ্রবেশঃ কালরাত্রি” নামক কবিতা সুংগ্রহে।
   “ওঁ হ্রীং মহামারী রক্তাক্ষি কৃষ্ণবর্ণে সমস্যাজ্ঞাকারিণি
   সর্বভূতসংহারকারিণি রন্তক বামাদ্যা খড়্গিনী রাক্ষসং হন হন ঔঁ দহ দহ ঔঁ ...”
                                                            (আবাহন)

আবার
 “সেদিনও কমলেকামিনী রাতে চাঁদ উঠেছিল , কংকালী সরোবরে ফুটেছিল
নীলপদ্ম... আর আমরা অত্যাচারিত হলাম...”
                                                 (প্রার্থনা)
মহামায়ার ভীষনা মূর্তি তামসিকতার আঘ্রাণে কোথাও প্রবল হয়েছে , কখনো মাতৃ্ত্বের পুষ্টিতে হাবুডুবু খাচ্ছে বিশ্বকোষ।
“... তখনো ন্যাগ্রোধ গাছের নীচে মা বসে আছেন
    দুপাশে বাসিলের বাটি রেশমকীটের রক্তে টইটুম্বুর...... রাক্ষসের রক্তে টইটুম্বুর......
    ...
    ফালক জালক সিংহীতিকা মায়ের বুকের হাড়... ভরভরন্ত দুধ
    দরদরিয়ে উপচে যাচ্ছে নেবুলা চুচুকে...”
                                            (মহাপদাবলী-১ রাক্ষসের ব্যূহপ্রবেশঃ কালরাত্রি)

“...জিনে জিনে রন্তকের বলবর্দ রিরিংসার জ্বালা পঞ্চ ম-কার খেয়ে আকাশ লিঙ্গ খেয়ে ব্রহ্মাণ্ডের যোনিপীঠে চকোৎ-  এর নেশায় চুর গস্তানী মাগী কাত্যায়নী মা হশি্যুঁ ...”
                                                 (সঙ্গহীন গর্ভযাত্রা)


কবিতাটির শেষ অংশে,
“আর কেউ বেঁচে নেই মাগো... একমাত্র  তোর দিকে গতি মা ভবানী...
ন তাতো ন মাতা ন বন্ধুর্ন নপ্তা    ন পুত্র ন পুত্রী ন ভৃত্যে ন ভতা
ন জায়া ন বিদ্যা ন বৃত্তির্মনৈব     গতিস্ত্ং গতিস্ত্ং ত্বমেকা  ভবানী...”
                                                    (সঙ্গহীন গর্ভযাত্রা)
মনে হয় ফেরোমন হাতে অসংখ্য শ্লোকপীপিল ডুবেছে তন্ত্র-সাধনায়।
শক্তি রূপান্তরের নিয়ম মেনে চলেছি , কবিতার চটুল দোলন নয় ,কঠিন মৃত্যুর মুখোমুখি দীর্ঘ সময় হেঁটে জন্মের প্রতি আক্রোশ স্বাভাবিক , তারই ফলস্বরূপ পাঠকের মনে এই স্থিতিশীল শক্তিপুঞ্জ গতিশক্তি রূপে জাগরিত। একদিকে স্বর্গ , প্রতিস্বর্গ, মন্বন্তর (ব্রহ্মাণ্ড থেকে মনুষ্য সৃষ্টির ইতিহাস) , অন্যভিকে নরকের মধ্যে স্বর্গ দেখার অ্যাডভেঞ্চার পাঠক পেলো। তন্ত্র ও বিভিন্ন পুরাণের চাঁদ ধরলো পাঠক নতুন আবহে । কুর্নিশ কবি তন্ময় মন্ডলকে , জীবন-মৃত্যুর অতল রহস্যে পাড়ি দিয়ে জড়বস্তুর মধ্যে বিচ্ছুরিত সাত রঙের সন্ধান দিলেন তিনি।স্থানু গতিশীল হোলো পরমাশক্তির দাপটে। প্রকৃতির শবদেহ খুলে গেল মহাপদাবলীর খোলসে , এ এক আশ্চর্য শব্দসেলাই , ফর্মালিনে ভেজা।

     “আমাদের এই মর্মান্তিক রাক্ষস জন্মে
যেন গাছে গাছে ধারালো ব্লেডের পাতা নিঃশ্বাস ফেলছে
ব্লেডের বিছানা বালিশ... ব্লেডের পোশাক পরেই
আমরা চলাফেরা করি আর প্রচণ্ড রক্তের ছাঁটে
ভিজে যায় মা সিনীবালীর বুক পেট পিঠ পাছা...”
                                       (মহাপদাবলী-২ রাক্ষসের ব্যূহপ্রবেশঃ কালরাত্রি)

পাশব কান্নায় পুড়ে যেতে যেতে ল্যাংটো হচ্ছে ধূরানি আপেল...
না
শেষ
   নেই... রক্তিন গর্গন মায়েদের ব্রণে কুরে খাওয়া মুখের শেষ নেই 
       তুমি কি দুধমতী চণ্ডবাহারী নাকি দশস্তনী দেবী আথাউলপা???
         রক্তবামনদের গর্জন শেখাও শুয়রের মতন মহিম ঘোঁঘোঁৎ ...”
               

                                               “রাক্ষস জন্মের কথামালা”
                                           তন্ময় মন্ডল
                                        সম্পাদকঃবারীন ঘোষাল