সব্যসাচী
হাজরা বলছি। আমার চোখে
কবি বারীন ঘোষালের দুটো দিক সমান ভাবে উজ্জ্বল ১। কবি ২। পাঠক । প্রথম পরিচয়ের সাথে সাথে দ্বিতীয় পরিচয়
টাও আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। কারন প্রকৃত পাঠকের সংখ্যা কবি-সংখ্যা থেকেও হয়তো কম।
আর কবিতার বিষয়ে তিনি কতটা নিরপেক্ষ আলোচক , কতটা আন্তরিক , কতটা উৎসাহক তা বোঝা
যায় তাঁর আলোচনা থেকেই। হ্যাঁ , আর সে কারনেই যে
মানুষ কবিতার মধ্যে বাঁচেন, সেই বারীন ঘোষালের পাঠ প্রতিক্রিয়া থাকছে দুটো সংখ্যায়। চারজন
কবির চারটি কবিতার বই। বারীনের চারটি চিঠি।
অন্যব্যাপার
অমিতাভ প্রহরাজ
অমিতাভ, বেবী, তোর এই
বইটাও ‘চলো সিঙ্গলহ্যান্ড’-এর মতোই স্টানিং। আমি অনেক আগে আমার একটা গদ্যে
‘বুকনেস’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলাম – যে লেখার প্রতি উচ্চারণে বই-এর মতো বই হয়ে
ওঠার যোগ্যতা আছে – বোঝাতে। তুই সঠিক অর্থে ‘ওয়ার্ডনেস’ শব্দটা দিয়ে সেই মর্মে
গ্রন্থনা করে গেলি। হাত কবিতা, হাতের লেখা, অবাকশিল্প, পাঁচজনের কাহিনী, ব্যাবিলন সমঝদার, নষ্ট আলজিহ্বা, এই সব
কমপোজিশনগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে “কগদ্য বা গপদ্য” – যে কবিতা গদ্যের কাছে যায় বা যে
গদ্য কবিতার শেষ হয়। ‘অন্যব্যাপার’-এ শব্দ, ভাষা আর বিন্যাসের এক নতুন রূপ এসেছে,
যা অনেকদিন ধরে বাংলা কবিতার জগতে অপেক্ষায় ছিল। ‘নতুন কবিতা’র উন্মেষকালে আমরা যে
মেধা-চার্নিং করেছিলাম, যে সুফল পেয়েছিলাম, বাংলা শব্দ ও ভাষাকে কবিতার উৎসমুখে
নিয়ে গিয়েছিলাম এবং একটা অসচরাচর পরিসর এনেছিলাম কবিতা নির্মাণে, আজ তোর হাতে,
একলা তোর হাতে দেখলাম আরো নতুন দরজা জানালা, আলো হাওয়া, তৈরি হয়েছে একটা একেবারে
নতুন ‘ওয়ার্ডনেস’-এ। আমার ভীষণ ভাল লাগছে ভাবতে যে রিলেকাঠিটা এগিয়ে যাচ্ছে কারও হাত ধরে। সেই
ফিলজফিটাও বলেছিস ‘ব্যাবিলন’এ।
লেখাট্য একটাই দুর্বলতা লক্ষ্য করলাম। তা হল রচনাগুলোর
লিরিকক্রান্তি। তোর লিরিক ব্যবহারটা আমার মনে হয় অজানিতে হয়ে গেছে। সতর্ক হলে ভাল।
আর যদি স্বেচ্ছায় এই লিরিক স্নান উপভোগ করে থাকিস তাহলে পাঠক হিসেবে বলি, অমন
বুদ্ধিদীপ্ত গদ্যকথাও স্লো হয়ে গেছে, যেটা ভাল নয়। এই গদ্য-কবিতার পঠন আরো স্পিড
দাবী করে। যেন নাচতে নাচতে বম্বার্ডমেন্ট হচ্ছে। এছাড়া এই বই-এর প্রতিটি শব্দ,
প্রতিটি মোড় তুখোড়, সিম্পলি তুখোড় লেগেছে। আশীর্বাদ করি। সে তুই না চাইলেও করি। আশা
করব, এরপর ধীরে ধীরে বাংলা কবিতার চলন আরো গতি পাবে।
আমি তোর কবিতায় কোটস আর শাইন নিয়ে কোন
গতানুগতিক আলোচনা করলাম না আর। সে আরো অনেকেই করবে নিশ্চয়ই। ভাল থাকিস। সৃজনে থাকিস।
বারীনদা।
ডিসেম্বর সংহিতা
অর্ঘ্য ব্যানার্জী
অর্ঘ্য, তোর বইটা
আমাকে পড়লো। আমি ঢুকে যাচ্ছি পাতা থেকে ডালে, ঋতু পেরোতে পেরোতে ডিসেম্বরে।
‘রাতের/ কাঠচেরাইয়ের নিঃশব্দতা/ বাজছে মিছিমিছি’...... প্রথম কবিতার এই ওপেনিং
লাইনেরা চুম্বকের মতো ধরে রাখলো আমাকে। ‘বৃষ্টি, অনেক দিনের গ্রিনো’—‘রত ফুল তুমি’......
‘রোগা হলে জ্যোৎস্নার ফিতে’...... থেকে ‘পাখির ব্রিজ এই সন্ধ্যেবেলা’......
‘ওয়ার্ম ডাউন ডিসেম্বর’...... সবকটা কবিতা আমার ভাল লেগেছে। ভাল লাগার কারণ আছে
অনেক। তা হল – কবিতাগুলো ছোট, অতিরেকহীন, নির্মেদ, গল্প-নাটক-হীন, কোন অন্য কবির
প্রভাব নেই, পাংকচুয়েশন নেই, নতুন সিন্টাক্সিং আছে, খামোখা স্মার্টনেসের জন্য
ইংরিজি বা উর্দুর প্রয়োগ নেই, আর সর্বোপরি ভালবাসার কবিতা এসব। পড়তে খুব ভালো
লাগে। তুই যখন আসবি, দেখাবো, কিরকম দাগিয়ে পড়েছি। ট্রাজিডোর শব্দটা ভাল লেগেছে।
ভাল লাগেনি রোদাম্ন, গর্জট্রেন – এই শব্দগুলো। আমি ভাবছি এতদিন কেন যে বই
করিসনি। এই বইমেলায় আমার পাওয়া বাংলা কবিতার বইগুলোর মধ্যে ডিসেম্বর সংহিতা অন্যতম
শ্রেষ্ঠ বই।
বারীনদা।
কথা বলা চোখ
শৌভিক দত্ত
শৌভিক, তোর কবিতার
বইটা খুলেছিলাম আজকে। মনে হল একজন অতি সুন্দরী মহিলাকে কালো বোরখা পরানো হয়েছে।
প্রচ্ছদের কালো একেবারেই ভাল লাগেনি। অতনু বর্ণান্ধ হয়েছে। তোর কবিতার বইয়ে উৎসর্গ-বচন,
কবিতার পর্ববিভাগের শিরোনামগুলো এবং কবিতারা সবাই সুন্দর, রোমান্টিক, নান্দনিক,
নন-লিরিকাল হওয়া সত্বেও উচ্চারণে সাবলীল, প্রেমময় কথা বলার সমারোহ নিয়ে ধরাছোঁয়ার
মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমার খুব ভাললেগেছে কবিতাগুলো। দূরে থাকিস। দেখা হয় না।
কবিতা পড়া হয় না দু-তিনটে পত্রিকায় ছাড়া। এর আগের বইয়ের পরে তোর কবিতায় অস্বাভাবক
শিফ্ট হয়েছে লক্ষ্য করলাম। এখন যা লিখছিস তা পুরোপুরি নতুন কবিতা। কবিতা থেকে
বিষয় আর গল্প বিদায় হয়েছে। ভাবনার ফেব্রিকের মতো আঁশ ঝলমল করে যেখানে সেখানে।
উজ্জ্বল পংক্তিগুলো প্রতিভাবনা তৈরি করে পাঠকের মনে, আমারও মনে, সহজে, ঐ তো আমারও
কবিতা। তোর কবিতা লেখা এখানেই সার্থক হল। শব্দের স্থানে অনাশব্দ (অর্থে
আন-ইউজুয়াল, অসাধারণ) দিয়ে চমকে দিয়েছিস এবং নতুন ব্যঞ্জনা এনেছিস যেটা আমার দারুণ
ভাল লেগেছে। এই প্যারামাইড শিফট তোর আয়ত্তে এসে গেল।
কবিতার ব্যাখ্যা বা সারাংশ হয় না। নতুন
কবিতায় বিষয় থাকে না, গল্প থাকে না। সম্পূর্ণ কবিতা বলে কিছু হয় না। কারণ ফর্মের
বদলে ফর্মলেসনেস রপ্ত হয়েছে আজ। কারণ ভাস্কর্যের মতো নিখুত প্রতিমার ধারণা এখন
কবিতাকে মানায় না। সাধারণের ভাষা বোধের জন্য শব্দকে আর অমোঘ হবার প্রয়োজন নেই।
কারণ, আমরা জেনে গেছি যে কবিতা সাধারণ মানুষের কোনো কাজে লাগে না। তাই সেদিকে
তাকিয়ে তরল না করে আমাদের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করবো শব্দ। এটা কেবল স্থানান্তরনের
ব্যাপার নয়। তুই তাই করেছিস। এতৎসত্বেও তা যে নতুন ব্যাঞ্জনা সৃষ্টি করেছে সেদিকে
দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমি প্রায় সব কবিতাই দাগিয়ে পড়েছি, আমার অভ্যাস। অ্যাট র্যান্ডম
দেখা যাক –
‘......যে ডুবুরি আলো/ চেয়ারের মণিতে
রাখা/....../ নীল নীল কলোনিয়াম ফোটার কথায়’...... এভাবে সবটাই নতুন প্রয়োগ দেখতে
পাই। ডুবুরি আলো, চেয়ারের মণি, দোয়াত বাওয়া, নীল কলোনিয়াম ফোটা----- কী করেছিস
পাগলা---- কে ভেবেছিল এরকম শব্দস্থাপনও সম্ভব? আবার পরের কবিতায়ই---- ‘একটু নূর
জমছে / টোলপড়া / বেদকাঠে রোদ উঠে গেল/ পাল্লাবাড়ির দিকে বৃষ্টি আড়ত / রোগা কামিজেও
দেখো সাঁতার বসলো’...... সেই ভাল লাগা পাচ্ছি আবার। আমি কোথাও দেখিনি এরকম
শব্দস্থাপন ---- নূর জমা, টোলপড়া, বেদকাঠে রোদ ওঠা, পাল্লাবাড়ি, বৃষ্টি আড়ত, রোগা
কামিজে সাঁতার বসা ---- এরকম মুহুর্মুহু শব্দবাজি হাঁ করে দাঁড় করিয়ে দিল আমাকে।
খুলে গেল বেড়া। কী যে ভালো লাগলো!
তুই জানিস, এর পর সবকটা কবিতা থেকে এমন
উল্লেখের ইচ্ছে হচ্ছে। সেটা করছি না। কেবল তোর আর আমার কম বোঝাপড়া হলেই হল। বলি কি
– তুই যদি আমার কথা মেনে থাকিস যে, নতুন কবিতা এগুলো, তাহলে অনুরোধ, প্লিজ থামিস
না। এতদূরে একলা বসে তোর এই নির্জনের নিরবের কাজ আমাকে তাক লাগিয়ে দিল। বাহ্ বাহ্
করে উঠলাম। নির্মেদ, অতিরেকহীন, বাজার ও নেট প্রবনতার বাইরে এই কবিতার জবাব নেই।
ভাল থাকিস শৌভিক। থামিস না। তোরা এমন লিখলে আর তা পড়লে আমি বাঁচি। কখনো দেখা হলে
ভাল লাগবে। অনেক কথা হবে। শুভেচ্ছা ও ভালবাসায়
বারীনদা। ৫/৫/১৩
লোডশেডিং
অনির্বাণ
চট্টোপাধ্যায়
অনি, তোর কবিতার
বইটা বেশ কয়েকবার পড়ে ফেললাম। দাগে দাগে ভরে গেছে। একমাত্র তোকেই কখনো দেখাতে
পারবো। আবহমান বাংলা কবিতার চালু ফরমুলা অনুযায়ী বাঙালি পাঠকের জন্য বাঙালি কবির
রচনাগুলি আমরা পেয়ে এসেছি দুঃখ ব্যাথা বেদনা আনন্দ ফুর্তি যৌনতা ও ইদানীং কালের
নেট বিশ্বায়নের সাঙ্খ্যন্যায় (ডিজিটাল গ্যাজেটস) – এই সবের আবেগ দেওয়া ভিয়েনের
রসায়ন। তোর কবিতা আমাকে অন্য দড়জার সামনে দাঁড় করালো যার ভেতরে হাসাহাসির শব্দ
হচ্ছে।
তোর কবিতা চূড়ান্তভাবে কবিতাই, অতিরেকহীন,
কিন্তু তার মধ্যে এত হিউমার আর স্যাটায়ার আর উইট থাকা সম্ভব তা আমাদের ধারণা ছিল
না। অসাধারণ লেগেছে তোর এই কমপোজিশন গুলো নমুনা দেখাতে হলে পুরো বইটাই তুলে দিতে
হয়। সামান্য যা কিছু উল্লেখনীয় ত্রুটি মনে হয়েছে, না হলে ভাল হোত, সেগুলোর কথা
বলি। চেনা জানা মানুষের নামোল্লেখ চলে যেমন দেবা, ইন্দ্রনীল, বারীন ইত্যাদি।
কিন্তু সেলিব্রিটিদের যেমন অমিতাভ বচ্চন, কৃশানু দে, গীতা – এই সব নাম তোর কবিতায়
খাপ খায় না। কবিতার শেষে মরাল দেওয়া কবিতার পক্ষ্যে মজার হতে পারে কিন্তু একেবারেই
বাদ দেওয়া উচিত। কবিতাগুলো মোটের ওপর অ্যান্টিপোয়েট্রি। তাই ‘আবার লোডশেডিং’
পর্যায়ে ‘মতো’ বা ‘যেন’ শব্দ দিয়ে উপমার ছড়াছড়ি একদম মানায়নি তোর কবিতার স্পিরিটের
সাথে।
কেবল নিন্দে করছি ভাবিস না। যাটুকু না থাকলে
কবিতা আরো দামী হয়ে উঠতো তাই বললাম। ‘গরম ভাতের ফ্যান ঠান্ডা হলে আমি দেখি তাল,
জবুথুবু / এডমণ হিলারি’...... থেকে ‘বাবার সিগারেট নিভিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি / ও তার
একান্ত নিউটন ।।’পর্যন্ত পুরোটাই চেটেপুটে খেয়েছি। সাবাস অনির্বাণ।
বারীনদা